sad story ||Story: Ruposhi ||গল্প : রূপসী || কালো মেয়ের গল্প

©



গল্প : রূপসী
লেখা : আফরিন শোভা

বিয়েতে আমার মোটেও ইচ্ছে ছিল না। তারপরও মেয়েটার জন্য খুব খারাপ লাগছে। একে তো গায়ের রং কালো, তার উপর পড়ালেখা ও জানেনা। সাইজেও খাটো। মাত্র ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি, আর আমি ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি। পুরোই বেমানান। এরকম একটা বিশ্রী, কুৎসিত মেয়ের জন্য খারাপ লাগার কথা না, তবুও লাগছে। কেন লাগছে জানি না, হয়ত মানবতা বোধ থেকে!! আমার বাবা সব কিছু জেনে শুনে ও এই মেয়ের সাথেই আমাকে বিয়ে দিল। শুধু মাত্র টাকার জন্য। অথচ বিয়ের পর থেকে আমাদের বাড়ির কেউ মেয়েটার সাথে ভাল ব্যবহার করেনি। কিন্তু যৌতুকের ৫ লাখ টাকা আর এক ট্রাক ভর্তি ফার্নিচার ঠিকই পইপই হিসেব করে নিয়েছে। কিন্তু মেয়েটার সাথে করছে জঘন্য ব্যবহার, হয়ত সেজন্যই আমার খারাপ লাগছে। 
🌺 নতুন বউ আনার পর থেকে আশেপাশের বাড়ির ভাবিরা, চাচিরা, নানিরা ভিড় করছে আমাদের বাড়িতে। নতুন বউ এর রূপ দেখে তাদের ফিসফিসানি বেড়ে গেল। 
সমেদের নানি ঘোমটা তুলে জিজ্ঞেস করল, 
- বউয়ের নাম কিতা?? 
- রূপসী। 
মুহূর্তেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। 
- কাইল্লা মাইয়ার নাম রাখছে নি রূপসী?? তুমার বাপ মায় আর নাম খুইজ্জা পায়নাই?? 
মাথা নিচু করে অঝোরে কাঁদতে লাগল মেয়েটি। তাতে এইবাড়ির লোকদের একটুও খারাপ লাগেনি। বরং তারাও অন্যদের সাথে হাসাহাসি করতে লাগল। অবশ্য রমিজের দাদি এসেছিল সান্ত্বনা দিতে, 
- আল্লায় বানাইছে কালা, হেতে অর কি কুনু দুষ?? মাইয়া কালা না হইলে কি আর এতডি ধন সম্পত্তি পাইতা?? শুকরিয়া নাই তুমাগো?? 
সবাই মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। 
কথা কিন্তু সত্য। অন্তত আমার তা-ই মনে হল। "কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা" কথাটি অনেক বার শুনলে ও অর্থ বুঝিনি। কিন্তু আমার শ্বশুর বেচারাকে দেখে এর অর্থ উপলব্ধি করলাম। কালো মেয়ে জন্ম দিয়ে উনি যে কত বড় পাপ করেছেন!! সমাজের লোক এটাই তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বারবার। শুনলাম, আগামী তিন চার দিনের মধ্যে তিরিশ বিঘা জমির দলিল রেজিস্ট্রি করে আমার হাতে তুলে দিবেন। এতটা আশা করিনি আমি। পরে জানলাম, বাবাও জানতেন না। কিন্তু খবরটা জানার পর বাবা খুশিতে লাফিয়ে উঠলেন। আমার সারা জীবনে বাবাকে এত খুশি হতে কখনো দেখিনি। 


🌺 দিন চারেক পরে শ্বশুর মশাই তার তিরিশ বিঘা জমির দলিল হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, 
- জামাই বাবাজী, আমার মাইয়াডা আফনের জুতার তলার ও যোগ্য না জানি, তারপর ও একটা অনুরোধ, আমার মাইয়াডারে অাফনের দাসী বান্দি কইরা রাইখেন, খেদাইয়া দিয়েন না। 
বলে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন। 
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। এই হলো আমাদের সমাজ ব্যবস্থা!! যেখানে একটা মেয়ে নিজের বাবা মায়ের কাছ থেকেই সম্মান পায়না, সেখানে অন্য পরিবারের কাছ থেকে সম্মান আশা করবে কিভাবে?? 
🌺 নিশ্চিন্তে দিন কাটছিল সবার। হঠাৎ পাশের বাড়ির সমেদের কুটনি নানি এসে মায়ের মাথায় চিন্তার ঘুণ পোকা ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। 
- ওরে সফুর মা, ঐ কাইল্লা বউডারে তোমার পোলার কাছে অত ঘেঁষতে দিও না। শ্যাষে তুমার নাতি পুতিও কাইল্লাই হইবো। 
ব্যস, মা ও এখন থেকে চোখ কান খুলে সতর্ক হয়ে থাকে। অতঃপর মায়ের নির্দেশে রূপসীকে রোজ ঠান্ডা মেঝেতে শুতে হয়। আমি তার বাপের দেয়া দামি খাটে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমালেও রূপসীর এই খাটে শোয়ার কোন অনুমতি নেই। মাঘ মাসের প্রচন্ড শীতে ঠান্ডা মেঝেতে প্রতিদিন শোবার কারণে রূপসীর হাঁপানির কষ্ট আরও বেড়ে গেল। কিন্তু সেই খবর বাবার কানে যাওয়া মাত্রই তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, 
- মাইয়ার যে হাঁপানি আছে এইডা তো ওর বাপে কয় নাই। কত্ত বড় চিটিংবাজ শালা!!! 
অনেক অনুরোধ করেছিলাম বাবাকে ডাক্তার এনে দেখাতে। কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজি না। অবশেষে আমার পীড়াপীড়িতে মা গ্রামের এক কবিরাজকে এনে ঝাঁড় ফুক করালো। তাতে রূপসীর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেল। আমি বাবাকে বললাম, রূপসী কে ঢাকায় নিয়ে ডাক্তার দেখাবো। বাবা ক্ষেপে গেলেন, 
- দরকার নাই, মইরা যাক। আমার শিক্ষিত্ পোলার লাইগা মাইয়ার অভাব নাই। 
আমার আর সহ্য হলো না। জোর করে রূপসী কে ঢাকায় নিয়ে এলাম। এখানে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে লাগলাম, রূপসী কে ভালো ডাক্তার দেখালাম। রূপসী ও এতদিনে জড়তা ভেঙে আমার সাথে মিশতে লাগল। তবে, আমার সাথে বাইরে কারো সামনে বেরোতে চায় না, পাছে আমার অসম্মান হয়। কিন্তু আমি ওকে নিয়েই বেরোই, ঘুরতে যাই, বিভিন্ন পার্টিতে যাই। 
সবাই বাঁকা চোখে দেখে... দেখুক। 
নানা জনে নানা কথা বলে.... বলুক। 
আমার বন্ধুরা বিনা মূল্যে প্রায়শই আমাকে দামি একটা উপদেশ দিতো, "আমি যেন ভাল দেখে আরেকটা বিয়ে করি "
কিন্তু আমার পক্ষে সেটা আর সম্ভব নয়। কারণ এই কালো মেয়েটা আমার হৃদয়ের অনেকটা জায়গা জুড়ে গেঁথে গেছে। 
🌺 আজ আমাদের বিয়ের তিরিশ বছর পূর্ণ হলো। আমার শ্বশুরের দেয়া তিরিশ বিঘা জমির হিসেব আমার কাছে নেই। কিন্তু এই তিরিশ বছরের ভালোবাসার হিসেবের খাতা আজ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। এক কন্যা সন্তানের জনক আমি। মেয়ের গায়ের রং মায়ের মতোই কৃষ্ণবর্ণ। কিন্তু তাতে আমি মোটেও বিচলিত নই। বরং আমি আমার মেয়েকে এমন যোগ্য করে গড়ে তুলেছি যাতে জীবনে তাকে কারো কাছে কখনো মাথা নত করতে না হয়। উচ্চ শিক্ষা, নাচ গান থেকে শুরু করে মার্শাল আর্ট পর্যন্ত এমন কোন কিছু শেখাতে বাদ রাখিনি, যাতে কালো বলে কেউ আমার মেয়েকে অবহেলা করতে না পারে। আমি খুব ভালো করেই জানি, যদি পরিবার মেয়েকে সম্মান না দেয়, বাইরের কেউ কখনো তাকে সম্মান দিবে না। 
আজকে আমার মেয়ে বাংলাদেশের প্রথম নারী নভোচারী হিসেবে চাঁদে যাচ্ছে। পিতা হিসেবে আমি সত্যিই গর্বিত। 
রূপসীর চোখে জল, অঝোরে কাঁদছে সে। তবে এই কান্না কোন অপমানের নয়... কোনো লজ্জার নয়। এই কান্না গর্বের... প্রশান্তির।


ভাল লাগলে শেয়ার করবেন

Post a Comment

Thanks
© Priyo blog. All rights reserved. Premium By FC Themes