হিজামা কি? কেন? কিভাবে করবেন?

 হিজামা: একটি প্রাচীন ও সুন্নাহভিত্তিক চিকিৎসা

মনে রাখবেন হিজামা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি হারানো সুন্নাহ!

হিজামা সমাচার।

হিজামা কি?
হিজামা হল এমন একটি প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি, যাতে মানুষের সকল প্রকার শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সুস্থতা বিদ্যামান রয়েছে। যাকে বাংলায় শিঙ্গা এবং ইংরেজিতে Cupping therapy বলা হয়।

হিজামার পদ্ধতি
শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অংশ থেকে মেশিনের সাহায্যে অথবা শিঙ্গার সাহায্যে রক্ত চুষে নেয়া বা বের করে ফেলা। এরদ্বারা ভেতরের দূষিত রক্ত সদৃশ বর্জ্য দূর হয়ে যায়। যার ফলে মানুষ প্রশান্তি অনুভব করে।

কেন হিজামা করাবেন?
আপনার রোগ হলে যেমন ডাক্তারের কাছে যান। তারপর প্রয়োজন পড়লে অস্ত্রপোচারও করান। তেমনি আপনার রোগের জন্য হিজামা করাবেন। তাহলে ফায়দা স্বরূপ রোগ থেকে ইনশাআল্লাহ মুক্তি পাবেন এবং রাসূল সাঃ এর একটি সুন্নাতের উপরও আমল করা হল।

হিজামা কেনো করাবেন?
(১) শরীর থেকে ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ/Toxin বের করে নিয়ে আসে,
(২) লিভারকে পরিস্কার করে (Liver Detoxify)
(৩) শরীরের ব্যথা/ জ্বালাপোড়া হ্রাস করে,
(৪) ঘুমের উন্নতি করে,
(৫) শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি করে,
(৬) রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে,
(৭) পায়ের দুর্গন্ধ দূর করে,
(৮) কিডনি পরিশ্রুত করে,
(৯) বৃদ্ধ মানুষের বাত/ব্যথা নিরাময় করে,
(১০) ত্বক পরিষ্কার করে।
(১১) শরীরের জয়েন্টগুলোতে ব্যাথা,ঘাড় এবং ব্যাক পেইন দূর করতে সাহায্য করে।

হিজামা কাদের জন্য?

সকল বয়সী লোকদের জন্যই প্রযোজ্য। তবে বিশেষভাবে যারা:-

(১) ধূমপায়ীদের জন্য, যারা সিগারেট এর নিকোটিন বের করতে চান,
(২) দূর্বল লোকদের জন্য, যারা অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যায়,
(৩) যারা শরীরের ভিতরের বিষাক্ত টক্সিন দূর করতে চান।
(৪) যাদের জয়েন্টগুলোতে ব্যাথা, ঘাড় এবং ব্যাক পেইন আছে।
(৫) যারা ধুলাবালিতে সারাক্ষণ বিচরণ এবং সেই সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করেন।
(৬) যারা স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন।
(৭) যাদের শারিরীক যন্ত্রনায় ঘুম কম হয়।
(৮) বৃদ্ধ বাবা-মা যাদের বাতের ব্যথা আছে ,
(৯) যারা প্রতিদিন রাস্তায় চলাফেরা করেন।
(১০) যারা শরীরে বিষাক্ত টক্সিন আছে কিনা যাচাই করতে চান।

Toxin কি ?

এই গুলো হচ্ছে ওই বিষ যা আপনাকে একবারে মেরে ফেলবে না কিন্তু তিলে তিলে কষ্ট দিবে। প্রতিদিনই আমাদের শরীরে বিভিন্ন ভাবে এই toxin গুলো প্রবেশ করে, যেমন : খাবার খাওয়ার মাধ্যমে, বাহিরের ভাজা-পোড়া, ফলে বা মাছে থাকা ফরমালিন, পানিতে থাকা আয়রন বা আর্সেনিক, ধূমপানের অভ্যাস থাকলে, এছাড়াও আমাদের দেশের গাছ পালা কমে যাওয়ায় বায়ু দূষণ হচ্ছে, বায়ু ভারী হচ্ছে আর আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস এর মাধ্যমে আমাদের দেহে প্রবেশ করছে সীসা , অ্যালুমিনিয়াম, কপারের এর মতো ইত্যাদি ক্ষতিকারক বস্তু।

হিজামা তে এ কোন পার্শপ্রতিক্রিয়া নাই।

রাসূল (সাঃ) হিজামা সম্পর্কে বলেছেন প্রমাণ কি?

হিজামা সংক্রান্ত হাদীসঃ

★ হযরত আবু হুরাইরা রাঃ থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “জিবরীল (আঃ) আমাকে জানিয়েছেন যে, মানুষ চিকিৎসার জন্য যতসব উপায় অবলম্বন করে, তম্মধ্যে হিজামাই হল সর্বোত্তম।”
[আল-হাকিম, হাদীছ নম্বর: ৭৪৭০]

★ হযরত আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কেউ হিজামা করতে চাইলে সে যেন আরবী মাসের ১৭, ১৯ কিংবা ২১ তম দিনকে নির্বাচিত করে। রক্তচাপের কারণে যেন তোমাদের কারো মৃত্যু না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখবে।”
[সুনানে ইবনে মাজা, হাদীছ নম্বর: ৩৪৮৬]

★ হযরত আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “আমি মেরাজের রাতে যাদের মাঝখান দিয়ে গিয়েছি, তাদের সবাই আমাকে বলেছে, হে মুহাম্মদ, আপনি আপনার উম্মতকে হিজামার আদেশ করবেন।”
[সুনানে তিরমিযী হাদীছ নম্বর: ২০৫৩]

★ হযরত আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “গরম বৃদ্ধি পেলে হিজামার সাহায্য নাও। কারণ, কারো রক্তচাপ বৃদ্ধি পেলে তার মৃত্যু হতে পারে।”
[আল-হাকিম, হাদীছ নম্বর : ৭৪৮২]

★ হযরত জাবির রাঃ থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয় হিজামায় শেফা রয়েছে।”
[সহীহ মুসলিম, হাদীছ নম্বর: ২২০৫]

★ হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর রাঃ থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “খালি পেটে হিজামাই সর্বোত্তম। এতে শেফা ও বরকত রয়েছে এবং এর মাধ্যমে বোধ ও স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পায়।”
[সুনানে ইবনে মাজা, হাদীছ নম্বর: ৩৪৮৭]

★ হযরত আবদুল্লাহ্ বিন আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “হিজামাকারী কতইনা উত্তম লোক। সে দূষিত রক্ত বের করে মেরুদন্ড শক্ত করে ও দৃষ্টিশক্তি প্রখর করে।”
[সুনানে তিরমিযী, হাদীছ নম্বর: ২০৫৩]

হিজামার বিনিময় নেয়াটা কি ঠিক?

★ হযরত আনাস বিন মালিক রা.-এর নিকট হিজামাবৃত্তির উপার্জন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. হিজামা (নিজ শরীরে) লাগিয়েছেন। আবু তায়বা তাকে হিজামা করেছে। নবীজী তাকে দুই সা (সাত কেজি) খাদ্য-বস্তু দেওয়ার নির্দেশ দেন এবং তার মালিকদের সাথে আলোচনা করেন। এতে তারা তার উপর ধার্যকৃত কর কমিয়ে দেয়।
তিনি আরো বলেন: তোমরা যেসব পদ্ধতিতে চিকিৎসা করাও সেসবের মধ্যে হিজামা হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম ব্যবস্থা। অথবা তিনি বলেছেন এটি তোমাদের ঔষধের মধ্যে অধিক ফলদায়ক।
[সহী মুসলিম, হা/৩৯৩০ (হাদীস একাডেমী)
সহীহুল বুখারী, হা/২১০২ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স)]

★ হযরত আমর বিন আমির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি আনাস (রা) কে বলতে শুনেছি যে নবীজী সা. হিজামা লাগাতেন এবং হিজামা লাগিয়ে কোন লোকের পারিশ্রমিক কম দিতেন না।
[সহীহুল বুখারী, হা/২২৮০ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) সহী মুসলিম, হা/১৫৭৭, মাসনাদে আহমাদ, হা/১২২০৭]

★ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন নবীজী সা. হিজামা করালেন এবং যে তাকে হিজামা করেছে তাকে তিনি মজুরী দিয়েছিলেন। যদি তিনি তা অপছন্দ করতেন তবে তাকে পারিশ্রমিক দিতেন না।
[সহীহুল বুখারী, হা/২১০৩, ২২৭৯ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স)]

 অতএব, হিজামা করিয়ে পারিশ্রমিক নেয়ার অবৈধতা সংক্রান্ত বিধান পরবর্তিতে রাসূলুল্লাহ সা.-এর আমল ও নির্দেশ দ্বারা বাতিল/মানসুখ হয়ে গেছে।

হিজামা'র এর মাধ্যমে সাধারণত যে সব রোগের চিকিৎসা করা হয়ে থাকেঃ

★ মাইগ্রেন জনিত দীর্ঘমেয়াদী মাথাব্যথা
★ রক্তদূষণ
★ উচ্চরক্তচাপ
★ ঘুমের ব্যাঘাত (insomnia)
★ স্মৃতিভ্রষ্টতা (perkinson’s disease)
★ অস্থি সন্ধির ব্যাথা/ গেটে বাত
★ ব্যাক পেইন
★ হাঁটু ব্যাথা
★ দীর্ঘমেয়াদী সাধারন মাথা ব্যাথা
★ ঘাড়ে ব্যাথা
★ কোমর ব্যাথা
★ পায়ে ব্যাথা
★ মাংসপেশীর ব্যাথা (muscle strain)
★ দীর্ঘমেয়াদী পেট ব্যথা
★ হাড়ের স্থানচ্যুতি জনিত ব্যাথা
★ থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা
★ সাইনোসাইটিস
★ হাঁপানি (Asthma)
★ হৃদরোগ (Cardiac Disease)
★ রক্তসংবহন তন্ত্রের সংক্রমন
★ টনসিল
★ দাঁত/মুখের/জিহ্বার সংক্রমন
★ গ্যাস্ট্রিক পেইন
★ মুটিয়ে যাওয়া (Obesity)
★ দীর্ঘমেয়াদী চর্মরোগ (Chronic Skin Diseses)
★ ত্বকের নিম্নস্থিত বর্জ্য নিষ্কাশন
★ ফোঁড়া, খোস-পাঁচড়া সহ আরো বহুবিধ চর্মরোগ।
★ ডায়াবেটিস (Diabetes)
★ ভার্টিব্রাল ডিস্ক প্রোল্যাপ্স/ হারনিয়েশান
★ চুল পড়া (Hair fall)
★ মানসিক সমস্যা (Psycological disorder)...সহ আরও অনেক রোগ ইন শা আল্লাহ।

আরব দেশ সমূহ এবং ভারত-পাকিস্তানে হিজামার বহুল প্রচলন থাকলেও আমাদের দেশে হিজামা লাগানোর খুব একটা প্রচলন নেই। তবে সোশ্যাল মিডিয়া ও নেটওয়ার্কের কল্যাণে আমাদের দেশে এখন অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ হিজামা সম্পর্কে জানছে এবং এ চিকিৎসা ব্যবস্থার সুফল পেতে শুরু করেছে। জাপান, আমেরিকা, চীনেও আধুনিক পদ্ধতিতে হিজামা/শিঙ্গা/­Wet Cupping চিকিৎসা গ্রহন করা হচ্ছে।

রাসূল সাঃ এর যুগে এই চিকিৎসা খুব বেশি প্রচলিত ছিলো। রাসূল সাঃ একদিন ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে সাথে সাথে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে হিজামা করিয়েছেন। যেহেতু আল্লাহ তায়ালার রাসূল হিজামা নিজে করেছেন এবং অন্যদের করতে উৎসাহ প্রদান করেছেন তাহলে নিশ্চয়ই এরমধ্যে বহু উপকার রয়েছে। যার কিছু নমুনা উপরেও পেশ করা হয়েছে। তাই হিজামা করুন, অন্যকে করতে উৎসাহ দিন। একটা সুন্নাতকে জীবিত করুন। আমি নিজে হিজামা করেছি।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এই চিকিৎসা গ্রহন করার এবং ইখলাসের সাথে একটি সুন্নাতকে জীবিত করার তাউফিক দান করুন। আমীন।

*হিজামা সম্পুর্ণ ব্যাথামুক্ত এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত চিকিৎসা পদ্বতি।


Comments

Popular posts from this blog

HSC all text book Download | এইচএসসি সব পাঠ্য বই ডাউনলোড

একাদশ দ্বাদশ শ্রেণীর বই সমূহ ডাউনলোড – HSC Books Download pdf

আপনি 2022 সালে এই বক্স অফিস হিটগুলির কয়টি দেখেছেন?